1. বসন্তের গান
( Based on Keats Ode to a Nightingale )
তোকে যখন খুব মনে পড়ে , পুরো শরীর জুড়ে
একটা অসারতা নেমে আসে ।।
মনে হয় , এই মাত্র পান করা কড়া হেমলকের স্বাদ
অথবা মাত্রাতিরিক্ত মদ্য পানের নেশার থেকে
তোর স্মৃতিগুলো শরীরটাকে যেন
বায়ুর থেকেও বেশি হালকা করে দিয়ে যাচ্ছে ।।
এক মিনিটের থেকেও কম সময় কাটে নি এখনও
দূরে কোথাও অতীতের সেই শোনা পরিচিত কণ্ঠ
মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সেই সবুজ ক্ষেতের ধারে ,
জঙ্গলের ওপারে ; যেখানে আপন মনে বসে
বসন্তের গান গেয়ে চলেছে ; সেই কবে থেকে
পুন্য সেই আত্মা ।।
পুরোনো মদের গেলাসে সবে চুমুক দিয়েছি ,
বছরের পর বছর ওই জঙ্গলে মাটির তলে কেউ
সংরক্ষণ করে রেখেছিল ; আর তারই ওপর এসে মিসেছিল
নানা তৃন , গুল্ম , জংলি লতা পাতার বিষাক্ত স্বাধ ,
রোদে পোড়া , বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ আর
এক অদ্ভুত সুরের নেশা ।।
গেজিয়ে ওঠা সে তরলের প্রতি কণায় এক অদ্ভুত তৃপ্তি
এক অদ্ভুত শান্তি , ঠিক যেমন সে গেয়ে চলে যায়
বুকফাটা কান্না এক অদ্ভুত গানের মোড়কে ;
উত্তর থেকে দক্ষিণ ; পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তরে ।।
আমি সেই মন মাতালি নেশায় উড়ে যেতে চাই ,
সুরের রাজকন্যা ; তোমারই সাথে ,
এই কষ্টের সংসার থেকে অনেক অনেক দূরে ; নীরবে ।।
তুমি গেয়ে চলে যাও , দেশ থেকে দেশান্তরে
এ প্রান্তর থেকে তেপান্তরে ।।
আমি অবাক হয়ে শুনেছি তোমার গান ,
জঙ্গলের পথে , যখন কাঠুরেরা কাঠ কেটে
ঘরে ফেরে পেটের টানে ।।
আমি শুনেছি তোমার গান শহরের ভিড়ের মাঝে
যেখানে সংসার এসে বসে ঝগড়া করে , পরের নিন্দা করে ।।
আমি তোমার গান শুনেছি সেই ফাঁকা পথের পাশে
যেখানে সদ্য দুই প্রেমিক , ভালবেসে দুটো মনের কথা বলে।।
রূপ , রস , গন্ধ ও যৌবন;মিশে গেছে সব ওই কবরের তলে
শুনে দেখেছি তোমার গান , তাদের কষ্টের কথাও
বহুবার তুলে ধরে ।।
চলো না ফিরে চলে যাই , সেই পুরোনো দেশে
কোন গল্প নয় এখানে , শুধু তোমার কাব্যিক সৃষ্টি
আর তার সুরের রথে চেপে ।।
হাসছে দেখ সুন্দরী ওই নীল আকাসের চাঁদ
রাত্রি নেমে এসেছে পৃথিবী জুড়ে
অন্ধকারে ঢেকে গেছে চতুর্দিক ।।
স্বর্গের বাতাসের গন্ধে এক অদ্ভুত সুবাস
এরই মাঝে তোমার ঐ ডাক , এক অদ্ভুত শান্তি
নামিয়ে এনেছে জীবনে ।।
পায়ের নিচে চতুর্দিক আজ অন্ধকার -- তবু মনে হচ্ছে
সূর্যের রথে চেপে মহাপ্রস্থানের পথে আমি আর তুই
আর ওই দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের সেই সুর ।।
বিদায় পৃথিবী বিদায় ।।
বিদায় !! মনে হল ঘন্টা বাজছে দূরে ,
আলোয় ভরে উঠেছে চতুর্দিক , সূর্যের হাসিতে
পৃথিবী নতুন ভাবে সেজে উঠেছে ।।
তাহলে কি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম কোন ?
নাকি কাল রাত্রের কোন নেশার ঘোর
ভর করে ছিল আমায় ?
সে অমর সংগীত যার সঙ্গে এত গল্প আমার ,
যার ডানায় ভর করে পৃথিবী ছেড়ে নীরবে উড়ে গেছিলাম
অনেক দূরে , হঠাৎ সব থেমে গেল ।।
দূরের ক্ষেত , জঙ্গল , নদী পার করে নিরবেই হারিয়ে গেল
সেই সুর আর সেই গান : বিদায় পৃথিবী বিদায় ।।
2.যদি ভুলে যাও আমায় কোনদিন
( Based on Pablo Neruda's If you forget me )
একটা কথা তোমায় বলতে বড়ই ইচ্ছা করে ।।
আমি জানিনা , ঠিক এমন কেন হয় ,
যখন শরতের কুয়াশা ভেজা আকাশে
ওই লাল চাঁদটাকে দেখি ,
অথবা যখন আগুনে পোড়া কাঠের ছাই গুলো
পায়ের ওপর এসে জড়িয়ে ধরে আমায় ,
তখন তোমার কথা বড়ই মনে হয় ।।
এই যে সংসার , আর তার
রূপ , গন্ধ , সৌন্দর্য , দুঃখ , বেদনা :
এ সব কিছু মনে হয় এক একটা নৌকা
তোমার কাছে দৌড়ে পালাবার ।।
এবার যদি তুমি ধীরে ধীরে
আমায় ভুলে যাও , ভালবাসতে বন্ধ করে দাও ;
আমিও কিন্তু ভুলে যাব সমস্ত ভালোবাসার টান
তোমার প্রতি , ধীরে ধীরে ।।
যদি হঠাৎ কোনদিন ভুলে যেতে মনে হয় ,
ওই দুটি চোখ খুঁজতে আর না চায় আমায় ;
সময় যেন না নষ্ট হয় আর কোন
আমিও তোমায় ভুলে গেছি , এটা সত্য জেনো ।।
যদি কোনদিন এ সম্পর্কটি বড়ই জটিল আর
পাগলামি বলে মনে হয় তোমার ,
যদি এতগুলো বছর , বয়ে চলে যাওয়া হাওয়া ;
বৃষ্টির ভিজে ফোঁটা , যেগুলো ভিজিয়ে গেছিল
আমাদের একদিন -
মনে হয় এ সব বৃথা একটা যাত্রা শুধু
হৃদয়ের কিনারায় সে রাতে চলে যেও নির্দ্বিধায়
আমাকে ছেড়ে ।।
কিন্তু মনে রেখ , সেই দিন থেকে ;
সেই মুহূর্ত থেকে আমিও তোমায় ভুলে গিয়ে
নৌকার দাঁড় বেয়ে আবার এগিয়ে চলব
নতুন কোন মোহনার খোঁজে ,
ফিরে দেখবার কিন্তু কোন সুযোগ নেই ।।
কিন্তু যদি আমায় নিজের মনে হয় ,
আমাদের ভালোবাসার প্রতিটা ঘন্টা তোমার
যদি খুঁজে ফেরে আমায় ।।
নতুন ফুলের মত আমার এ বাগিচায়
যদি নতুন গন্ধে ফুটে উঠতে তোমার মন চায় ---
তবে বলি , তুমি শুধুই আমার হয়েই থাকবে ;
আমার ভালবাসা শুধু তোমার হয়েই বাঁচবে ,
এই দুটি চোখ , দুটি হাত এক হয়ে জড়িয়ে রাখবে
একটি জীবনে ;
মৃত্যু যদি আসে আসুক , ভালবাসা অমর থেকে যাবে
সেদিনও আমাদের মরনে ।
3.অনেক পথ পেরিয়ে
( Based on an unknown English poem )
অনেক পথ পেরিয়ে তোমার সেই চেনা দরজায়
আবার এসে দাঁড়ালাম আজ ।। শরীর বেশ ক্লান্ত
চারিপাশ আজ খুবই নিস্তব্ধ , শুধু সেই বুড়ো বটের ডাল
আজও দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়,ঠিক যেমনটা ছেড়ে গেছিলাম সেবার ।।
পাশে নদীটার বেশ কিছু যৌবন বয়ে গেছে মনে হয়
আজ তাই খুবই শান্ত ।। চাঁদের হাসিটাও ম্লান ,
মুখজুড়ে কালো কালসিটের দাগ ।।
অন্ধকার সেই দরজায় , জড়িয়ে থাকা সরীসৃপের মত
গুল্ম লতার ওপর দিয়েই দুটো টোকা দিলাম এইবার --
কেউ আছো ?? কেউ আছো ?? কেউ আছো ??
তিনবার হাঁক দিলাম আবার ।। নিস্তব্ধতা ক্রমে ক্রমে
গ্রাস করল আরও আমায় , অনুভব করছিলাম
দোতলার ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে কারুর নেমে আসার শব্দ ।।
একজন নয় বুঝতে পারলাম , বেশ কয়েকজন --
নিচের ঘরে এসে ভিড় জমাল ।।
আবার ডাক দিলাম জোরে ওই তিনবার ,
কেউ আছো ভিতরে -- আমি তোমাদের খোকন গো ,
পূব গাঁ থেকে এসেছি তোমাদের খোঁজে ,
আনন্দি , আছ নাকি ভিতরে ??
খোকন !! নামটা শুনে ভিতরে একটা হুলুস্থুলুস কান্ড
আর বাইরে প্রকৃতির মধ্যে চাঁদের সাদা চাদর জড়িয়ে
অপেক্ষায় দশ বছর পেরিয়ে আসা খোকন ।।
বুঝতে পারলাম এবার , ভিতরে আজ কেউ নেই
কাছে টেনে নেওয়ার মত ।। কেউ নেই ঘরে
একটিবার যার কোলে মাথা রেখে খুঁজে নিতাম
শান্তিময় কিছু মুহূর্ত ।। আর আমার আনন্দিও নেই --
এক অচেনা ঝরে বছর দুয়েক আগে উড়িয়ে নিয়ে গেছে সব
দাঁড়িয়ে শুধু একা বাড়িটা , কিছু সরীসৃপ গুল্ম লতা আর
তাদের ঘিরে থাকা কিছু অশরীরী ।।
আস্তে আস্তে পিছিয়ে এলাম , ঘাসের মসমস শব্দের সাথে
ফিরে চললাম নিজের দেশে ।। যাওয়ার আগে বলে গেলাম
ভাল থেকো তোমরা , আমি চলে যাচ্ছি নিজের দেশে ।।
এগিয়ে চলা পথের পিছনে অন্ধকার নীরবতা ফেলে এলাম ,
পোড়ো ঘরটা নীরবে চেয়ে আমার দিকে , দুটো পেঁচা উড়ে গেল
বাড়ির ছাদ থেকে মাথার ওপর দিয়ে ।। মনে হল ,
কে যেন বলছে , ভাল আছি ; ভাল থেকো -- তোমার আনন্দি ।।
4. উচিত বিচার
BASED ON MILTON's PARADISE LOST
ভাগ -১
মানুষের প্রথম পাপ এবং তার ফল ,
মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি এনে দিল l
স্বর্গ হারা হয়ে মানুষ ছিল ;
অসভ্য , বন্য , বর্বর l
ধন্য সেই পুণ্যাত্মা ,
যার জন্য এসেছি ফিরে তোমার কাছে আজ ,
জানতে শুধু , কেন তুমি দুরে
ফেলে দিলে মোদের বাপ মা রে -
কী ছিল তাদের পাপ ?
জানি ; লোভে পাপ , পাপে মৃত্যু ,
তবু ; ছিল না কি উপায় ?
যাহাতে তাদের তুমি ফিরিয়া লইতে
আপন বক্ষে l
ফিরাইয়া দিতে তাদের হারানো স্থান l
কে ছিল সেই দেবপুত্র?
যার প্রলোভনে মরিল শত বীর যোধ্যা l
হে দেবী , বল মোরে ;
কেমনে ঢুকিল সে , এ নন্দনকাননে ?
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন হতে ,
তুমি ছিলে এ ধরাভূমিতে l
কৃপা করে বল মোরে সে কাহিনী ,
যেথা হারিল শয়তান ,
স্বর্গ হতে বিতারিত হলো দূর নরক ধামে l
যেথা আলো নেই , নেই বাতাস l
তবু , কেন করিল না সন্ধি তোমার সাথে !
হে দেবী , বল মোরে
কেন তুমি দুরে ফেলে দিলে সমগ্র মানবেরে?
যদি সেই ফলেই মোদের পাপ -
তবে কেন রচিলে এ লীলা ,
যেখানে সেই স্বর্প দেখালো আপন খেলা l
কিসের সে জ্বালা ; যে বারবার ঢুকতে চায় সে,
এ স্বর্গধামে l
জানি আমি , তুমি নিরুত্তর l
তবে , শোন মোর কথা ,
পারলে একবার ঘুরে আসিও সেথা l
দেখে এস সে দুর্দশার ছবি এবং পারলে;
একবার ভেবে দেখো ,
এই কি তোমার উচিত বিচার ?
ভাগ ২
ধীরে ধীরে যখন জাগিল শয়তান
হারাইয়া আপন গৌরব l
চারিদিকে ফিরি দেখিল সেই স্থান ,
যেথা থাকতে হবে বন্দী
তাদের চিরকাল l
যেথা পড়িয়া আছে , বিক্ষিপ্ত ভাবে
তারিই মন্ত্রিপরিষদ l
মন করে ধিক ধিক ; তবু তো সৈনিক ,
হেরে যাওয়া কি তার শোভা পায়!
পাতাল গভীর মাঝে নরকের রাজা
সাজে রণসজ্যায় l
পরদিন প্রভাতে সম্মধিয়া সভাসদে
কহিতে লাগিল সে ,
" যদিও হারায়ছি স্বর্গ , নেই সে মোদের গৌরব l
তবু মোরা হারি নাই l
কিসের দুঃখ , কিসের ব্যথা ?
যেথা স্বর্গ , সেথাই নরক ,
ভিন্ন কিছু নাহি l "
ভাগ ৩
দেবী , করি সর্বশেষ প্রার্থনা আজ
যত খুশি শাস্তি দাও তুমি শয়তানেরে ,
তবু কৃপা করে ফিরাইয়া লও
তাদের আপন বক্ষে ,
যারা করে নি কোনদিন তোমার অপমান
কৃপা করে ফিরাইয়া দাও তাদের সেই গৌরব স্থান ।
তুমিই তো বলেছ , ক্ষমা পরম ধর্ম
তবে এ কিসের ন্যায় , কেমন বিচার ?
হে দেবী , করি আবেদন আজ
শক্ত হাতে কর দমন তুমি পাপকে ,
পাপীকে ফিরাইয়া দাও তার হারানো স্থান ,
তবেই হবে তোমার জয় , তোমার উচিত বিচার ।।
Comments